বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে এমন কিছু সিনেমা রয়েছে যেগুলো সময়ের সাথে সাথে শুধু জনপ্রিয়তাই অর্জন করেনি, বরং দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। এসব চলচ্চিত্রের পেছনে লুকিয়ে থাকা কাহিনীগুলো তাদের সৃষ্টির গল্পকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলে। আজ আমরা আলোচনা করব বাংলাদেশের সেরা পাঁচটি চলচিত্র এবং তাদের পর্দার পেছনের গল্প নিয়ে।
১. তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩)
রিতিক কুমার ঘটক পরিচালিত এই কালজয়ী চলচ্চিত্রটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভারতের চলচ্চিত্র উৎসব থেকে শুরু করে কান চলচ্চিত্র উৎসব পর্যন্ত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। পরিচালক রিতিক ঘটক ক্যান্সারের সাথে লড়াই করতে করতে এই সিনেমাটি নির্মাণ করেন। মেলোড্রামাটিক স্টাইল এবং শক্তিশালী সামাজিক বার্তার জন্য এটি বিশেষভাবে প্রশংসিত। গ্রামীণ জীবন ও পরিবেশের চিত্রায়ণে এই সিনেমা ছিল অনন্য, যা বাংলা চলচ্চিত্রে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করে।
২. আগুনের পরশমণি (১৯৯৪)
হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত অন্যতম সেরা সিনেমা। পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ নিজেই সিনেমাটির স্ক্রিপ্ট লেখেন এবং এটি পরিচালনা করেন। সিনেমাটির শুটিং এর সময় বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, বিশেষ করে যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে বাস্তবসম্মত পরিবেশ তৈরি করতে। এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন বরেণ্য অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর এবং বিপাশা হায়াত। সিনেমাটির মুক্তির পর ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে একাধিক পুরস্কার অর্জন করে।
৩. মাটির ময়না (২০০২)
তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের স্থানকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। এটি ২০০২ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ পরিচালকের পুরস্কার লাভ করে। সিনেমাটির পেছনের গল্পটি অনুপ্রাণিত হয় তারেক মাসুদের নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতা থেকে। সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র কিশোরী অনু এবং তার পরিবার নিয়ে গল্পটি আবর্তিত। ‘মাটির ময়না’ কেবল সিনেমা নয়, এটি বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজের একটি সময়ের প্রতিচ্ছবি।
৪. আঁখি ও তার বন্ধুরা (১৯৯০)
অভিষেক পরিচালনায় মুহাম্মদ জাফর ইকবালের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই শিশুতোষ চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এক অনন্য সংযোজন। চলচ্চিত্রটি বাংলাদেশের শিশু চলচ্চিত্রের ধারায় এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। শুটিংয়ের সময় শিশুদের সাথে কাজ করা এবং তাদের প্রকৃত আবেগকে ফুটিয়ে তোলা ছিল পরিচালকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সিনেমাটি শুধুমাত্র শিশুদের জন্যই নয়, বরং প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও একটি বার্তা বহন করে, যা শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের আহ্বান জানায়।
৫. গেরিলা (২০১১)
নাসির উদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘গেরিলা’ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আরেকটি শক্তিশালী চলচ্চিত্র। সিনেমাটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বই থেকে অনুপ্রাণিত। গেরিলা যোদ্ধাদের সাহসিকতা, বীরত্ব এবং আত্মত্যাগকে কেন্দ্র করে নির্মিত এই সিনেমাটি মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দর্শকদের মন জয় করে। এই সিনেমাটির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে একটি স্বতন্ত্র পরিবেশ তৈরি করা এবং তা বাস্তবসম্মতভাবে চিত্রায়িত করা। অভিনয়ে জয়া আহসান এবং ফেরদৌস সহ আরও অনেকেই অবদান রাখেন, যারা এই সিনেমাটিকে স্মরণীয় করে তুলেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতের এই সেরা পাঁচটি চলচিত্র কেবল বিনোদনের জন্যই নয়, বরং দেশের সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পর্দার পেছনের চ্যালেঞ্জ এবং পরিচালকদের সৃজনশীলতা এসব চলচ্চিত্রকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই সিনেমাগুলো দেখার মাধ্যমে আমরা দেশের অতীত এবং বর্তমানকে আরও ভালভাবে বুঝতে পারি।